প্রথমেই বলে নিই,আমাদের বাংলাদেশে কোয়েলের জাত-পাতের বালাই নাই।নির্দিষ্ট কোনো ব্রিডিং প্ল্যান না থাকায় আর ব্যক্তি পর্যায়ে যে যার মত করে ব্রিডিং করার কারণে কোয়েলের জাত হয়ে গেছে এখন পাঁচমিশালি।
তবুও আমাদের দেশে প্রাপ্ত কোয়েলকে আমরা জাপানিজ কোয়েল বলেই চিনে থাকি। কারণ, জাপানেই কোয়েলকে সর্বপ্রথম গৃহপালিত করা হয়েছে। জাপানের হিসেব অনুযায়ী কোয়েলের কয়েকটি জাত এবং উপাজত রয়েছে,সেগুলো নিচে দেয়া হলঃ
লেয়ার জাতের কোয়েলঃ মুরগির মতো কোয়েলের মধ্যেও লেয়ার জাত বিদ্যমান। এই জাতের উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী হলো-
- ফারাও
- ইংলিশ হোয়াই
- ম্যানচিরিয়াল গোল্ডেন
- ব্রিটিশ রেঞ্জ ইত্যাদি।
এই জাতের কোয়েলকে শুধু ডিম প্রদানের জন্য পালন করা হয়ে থাকে।
ব্রয়লার জাতের কোয়েলঃ মুরগির মতো কোয়েলের মধ্যে ব্রয়লার জাত বিদ্যমান এই জাতের উল্লেখযোগ্য গোষ্টি হলো-
- আমেরিকান বব হোয়াইট কোয়েল
- ইন্ডিয়ান হোয়াইট ব্রেস্টেড কোয়েল ইত্যাদি।
এই জাতের কোয়েলকে শুধু মাংসের জন্য পালন করা হয়ে থাকে।
শুধুমাত্র জানার জন্য এই জাতগুলার নাম জেনে রাখুন। খুঁজতে গেলে বিপদে পড়বেন। কারণ আমাদের দেশে জাত-পাতের বালাই নেই -এটা আগেই বলে দিয়েছি।
কেন কোয়েল পালন করবেন?
অন্যান্য পোল্ট্রির চেয়ে কোয়েল পালনের সুবিধা বেশি আর ঝুঁকি বলেই আপনি কোয়েল পালন করবেন।তো চলুন জেনে নেয়া যাক কোয়েল পালনের সুবিধাগুলো কি কি...?
- কোয়েলের শারীরিক বৃদ্ধির হার বেশি।
- ৬-৭ সপ্তাহে বয়সে ডিমপাড়া শুরু করে।যদিও বাস্তবে আরো ৫-৭ দিন বেশি সময় লাগে।
- বছরে গড়ে ২৫০-৩০০ টি ডিম পাড়ে ।
- একটি মুরগীর জায়গায় ৮ টা কোয়েল পালন করা যায়।
- ১৭-১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
- ডিমের পুষ্টিমান কোনো অংশে মুরগির ডিমের চেয়ে কম নয়।
- কোয়েলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি।সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
- ডিমের উর্বরতার হার শতকরা ৮০-৯০ ভাগ।
- অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অল্প দিনে বেশী লাভ করা যায়।
- ডিমে কোলেস্টেরল কম এবং প্রেটিনের ভাগ বেশি।
- কোয়েলের দৈহিক ওজনের তুলনায় ডিমের শতকরা ওজন বেশী।
- বাংলাদেশের আবহাওয়া কোয়েল পালনের উপযোগী।
- কোয়েলের জন্য বিশেষ কোন খাবার সরবরাহ করতে হয় না। এদের খাদ্য চাহিদা কম অথচ,শারীরিক বাড় খুব বেশি। এরা খুব দ্রুত বাড়তে পারে। দিনে ২০ থেকে ২৫ গ্রাম খাবার দিলেই এরা এদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদা পূরন করে নিতে পারে।
কোয়েলের বাসস্থান
কোয়েল পালনের জন্য যেহেতু অল্প জায়গার প্রয়োজন সেহেতু আপনি আপনার বসতবাড়ির আশেপাশে আর শহরে হলে বাসায় ছাদে কোয়েল খামার করতে পারেন।খামার যেখানেই করুন না কেন,জায়গাটা হতে হবে আলো বাতাস যুক্ত ও বন্যপ্রাণীদের নাগাল মুক্ত।
কোয়েল সাধারনত ২ ভাবে পালন করা যায়-
- লিটার বা ফ্লোর পদ্ধতি
- খাঁচা পদ্ধতি
লিটার পদ্ধতিতে কোয়েল পালন
এই পদ্ধতিতে সাধারনত কাঁচা মাটির উপরে বা পাকা ফ্লোরে লিটার অর্থাৎ শুকনো কাঠের গুড়ি (স”মিল এ পাওয়া যায়),ধানের তুষ বা চিটা অথবা বালি ৫-৬ ইঞ্চি পুরু করে বিছিয়ে দিয়ে তার উপরে কোয়েল পালন করা হয়।
লিটার ব্যবস্থাপনাঃ
লিটারঃ পোল্ট্রির ঘরে শয্যা হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন বস্তুকে লিটার বলে৷ এক কথায় বাসস্থানকে আরামদায়ক করার জন্য কোয়েলের ঘরে যে বিছানা ব্যবহার করা হয় তাই লিটার।
লিটারের উপকরণঃ লিটার হিসেবে সাধারণত ধানের তুষ, করাতের গুঁড়া,ধান বা গমের শুকনো খড়ের টুকরো,কাঠের ছিলকা, বাদামের খোসার গুঁড়া ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়৷ এগুলো এককভাবে ব্যবহার না করে সাধারণত কয়েকটি একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা ভাল।
লিটার প্রস্তুতঃ
- শুরুতে ৪ সে.মি. পুরু লিটার সামগ্রী পরিস্কার মেঝেতে ছড়িয়ে দিতে হবে৷
- ধীরে ধীরে আরো লিটার সামগ্রী যোগ করে ৪-৫ সপ্তাহের মধ্যে এই পুরুত্ব ৬ সে.মি.-এ উন্নীত করতে হবে৷
- ব্যাটারি ব্রুডারে পালিত বাচ্চার ক্ষেত্রে শুরুতেই ৬ সে.মি. পুরু লিটার ব্যবহার করতে হবে৷
- স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাজা লিটার সামগ্রী বিছানোর পরপরই কোনো উৎকৃষ্টমানের ও কার্যকরীজীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে৷তবে, বাচ্চা নামানোর ৭২ ঘন্টা পূর্বেই একাজ শেষ করতে হবে৷
লিটারের পরিচর্যাঃ
- উৎকৃষ্ট লিটারের আর্দ্রতাসবসময় ২৫-৩০% হওয়া উচিত৷
- অতিরিক্ত আর্দ্রতা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে৷
- লিটারের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষার জন্য ঘনঘন লিটার উল্টেপাল্টে দিতে হবে৷
- ঘরে বায়ু চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে৷
- বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে গেলে ৪-৫ কেজি/১০ ঘনমিটার জায়গা (ফ্লোর এরিয়া) হিসেবে লিটারে কলিচুন (স্ল্যাকড লাইম) যোগ করতে হবে৷
- পানির পাত্রের চারদিকের ভেজা লিটার বদলে তাজা লিটার সামগ্রী দিতে হবে৷
- অতিরিক্ত গরমে লিটারের আর্দ্রতা কমে গেলে স্প্রে’র মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে আর্দ্রতা ঠিক রাখতে হবে৷
লিটার পদ্ধতিতে পালনের সুবিধা
প্রথমেই বলে নিই লিটার বা মেঝে পদ্ধতিতে কোয়েল পালনের সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি।তবুও কিছু সুবিধা তো আছেই।যেমন-
- লিটারের দ্রব্যাদি সহজলভ্য আর সস্তা
- এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র ঘর তৈরি করেই মেঝেতে পাখি পালন করা যায়।তাই খরচ কম হয়।কিন্তু খাচা পদ্ধতিতে ঘর এবং খাচা দুটোই তৈরি করা লাগে তাই খরচ বেশি হয়।
- কোনো পাখি রোগাক্রান্ত হলে বা কোনো সমস্যা দেখা দিলে সহজেই খামারের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাখি গুলা সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়।
লিটার পদ্ধতিতে পালনের অসুবিধা
লিটার পদ্ধতিতে কোয়েল পালনের অসুবিধার কথা বলে শেষ করা যাবে না।তবুও কিছু না বলে আর থাকতে পারছি না।
- এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত লিটার দ্রব্যাদি জমাট বেঁধে খামারে এমোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হয়।যা পাখির জন্য খুবই ক্ষতিকর।এতে পাখি মারা যেতে পারে এবং ডিমের উৎপাদন কমে যেতে পারে।
- লিটার জমাট বেঁধে যায় বলে মাঝে মাঝেই লিটার উলট পালট করে দিতে হয়।যা কষ্টসাধ্য।
- এই পদ্ধতিতে পাখি লিটার বা মেঝের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডিম পাড়ে ফলে ডিম সংগ্রহ করার কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
- ডিম পেড়ে পাখির যদি দৌড়াদৌড়ি করে বা একটা আরেকটাকে তাড়া করে তবে লিটারে পড়ে থাকা ডিম ভেঙ্গে যায়।যা খামারের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারন।
- এছাড়া ঘরের মধ্যে ইঁদুর বা ছুঁচো ঢুকে ডিম বা পাখি খেয়ে ফেলতে পারে।
- এই পদ্ধতিতে রোগ-জীবানু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।কারন পাখি লিটারের উপরেই পায়খানা করে এবং সেই পায়খানা থেকে রোগ-জীবানু সৃষ্টি হতে পারে।
- লিটার নষ্ট হয়ে গেলে মাঝে মাঝে তা পরিবর্তন করে দিতে হয়।যা কষ্টসাধ্য এবং একই সাথে ব্যয়বহুল।
- খাবার ও পানির পাত্র মেঝেতে একটা একটা করে সাজিয়ে দিতে হয়।তাই প্রতিদিন অনেক গুলা পাত্র বের করে পরিষ্কার করে আবার পানি ও খাবার ভরে সাজিয়ে দিতে হয়।এটা সময় সাপেক্ষ ও বেশি শ্রম লাগে।
- লিটারের উপরে পড়ে থাকা পায়খানা বা মল পাখির পায়ের সাথে জড়িয়ে গিয়ে তার সাথে লিটার মানে গাছের গুড়ি বা তুষ মিশে পাখির পায়ে শক্ত গুটির মত সৃষ্ট হয়।ফলে পাখি হাটতে পারে না।যার কারনে খাবার ও পানি খেতে পারে না।পাখি শুকিয়ে যায় অবশেষে মারা যেতে পারে।
- পাখির পালক পড়ে যায় সহজেই।
- এছাড়া লিটারে পালন করলে কোয়েলের কৃমি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
No comments:
Post a Comment